সামনে স্বয়ং ‘দাদাঠাকুর’, তবু পর্দার দাদাঠাকুর ছবি বিশ্বাসকে দেখতেই উপচে পড়া ভিড়! জানা আছে সেই গল্প?

‘জলসাঘর’-এর পর্দা নেমেছে বহু দিন আগে, তবু বিশ্বম্ভর রায়ের মুখ বলতেই আজও যে একটি ছবিই চোখে ভাসে—তিনি ছবি বিশ্বাস। ছোটবেলায় মায়ের দেওয়া সেই নামেই যিনি একটা সময় শাসন করেছেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রি।
১৯০০ সালের ১২ই জুলাই, কলকাতার বিডন স্ট্রিটের নাট্যপাড়ায় জন্মেছিলেন শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। শৈশবেই তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় ‘ছবি’। মঞ্চনাটকের আলো-আঁধারি থেকে সিনেমার রুপোলি পর্দায় তাঁর যাত্রা ছিল এক নতুন দিগন্তের সূচনা। বাংলা চলচ্চিত্রে আধুনিক অভিনয়ের যে ধারা আজ স্বীকৃত, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এই মানুষটি।
সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়, ‘দেবী’-র কালীকিঙ্কর কিংবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র ইন্দ্রনাথ—ছবি বিশ্বাস ছাড়া ভাবাই যায় না। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, “ছবি বিশ্বাস অভিনয়ে ফাঁকি দেননি এক মুহূর্তও। বরং তাঁর কাছ থেকে এমন অভিনয় আদায় করতে পেরেছি, যা ভাবনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।”
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, সন্ধেবেলা চিঁড়ের পোলাও খেতে যাওয়া, নিজের হাতে পান সাজিয়ে খাওয়া, ফুলের বাগানে সময় কাটানো, আবার কখনও নিজে রান্না করে খাওয়ানো—সব মিলিয়ে এক বর্ণময় জীবন ছিলো তাঁর। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু এই কারণে যে ছেলেরা চুরি করে খায়—এমন অনন্য যুক্তি ক’জন দিতে পারেন?
শুধু অভিনেতা নন, মানুষ হিসেবে ভীষণ বড় মনের। দুর্ভিক্ষের সময়ে চাল-ডাল পৌঁছে দিয়েছেন গ্রামের ঘরে ঘরে, হাসপাতালের জন্য জমি দান করেছেন। অথচ দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই পথ দুর্ঘটনায় চলে যেতে হয়েছিল তাকে। অ্যাম্বাসাডারে চেপে যাচ্ছিলেন জাগুলিয়া, মাঝপথে গাড়ির চালককে সরিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসে আর ফিরলেন না। সেদিন একটা ট্যাক্সিচালক গাড়ি চালাতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, “আজ ছবি বিশ্বাস মারা গেছেন, গাড়ি চালাব না।” এমন অভিমান বাংলা সিনেমার খুব কম শিল্পীর ভাগ্যে জোটে। ‘জলসাঘর’ থেকে ‘দাদাঠাকুর’, ‘দেবী’ থেকে ‘সপ্তপদী’—তাঁর অভিনীত চরিত্রেরা আজও পাঠ্যবইয়ের মতো উঠে আসে স্মৃতিতে। এবং যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে চেনেন, তাঁরা জানেন—এই মানুষটা শুধু সিনেমা করতেন না, সিনেমাকে বিশ্বাস করতেন।
বাংলার সিনেপ্রেমী মানুষদের মনে কী প্রভাব ছিল তাঁর সেটা একটা ঘটনাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়েছে ছবি বিশ্বাসের ‘দাদাঠাকুর’। সেই সময় জঙ্গিপুর থেকে একটা কাজে কলকাতায় এসেছেন বাস্তবের দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎ পণ্ডিত। ছবির শো দেখতে ভিড় জমেছে শিয়ালদহর কাছে ছবিঘর হলে, সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন আসল ‘দাদাঠাকুর’—শরৎ পণ্ডিত নিজে। কেউ ফিরেও তাকায় না তাঁর দিকে। ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন ছবি বিশ্বাসও। সেই দৃশ্য দেখে পাশে থাকা বন্ধু বললেন, “ আপনি বেঁচে থাকতে আপনার জায়গায় আপনাকে না নিয়ে ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছে!” শরৎ পণ্ডিত শুধু মুচকি হেসে বলেছিলেন, “ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেওয়া।” মজা করে কথাটা বললেও এমনটাই ছিল অভিনেতা হিসেবে ছবি বিশ্বাসের বিশ্বাসযোগ্যতা।